২০১৯-এনকোভি - যা নভেল করোনা ভাইরাস নামে পরিচিত - সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নভেল করোনা ভাইরাস। সুদূর চীন থেকে বাংলাদেশে এখনো প্রবেশ না করলেও এই ভাইরাসে সংক্রমিত হবার ভয়ে সকলেই আতংকিত। করোনা ভাইরাস পরিবারের এই নতুন সদস্যের ব্যাপারে তেমন কোন তথ্য জানা না গেলেও গবেষকরা বলছেন, এর তীব্রতা সারস বা মারস করোনা ভাইরাসের চেয়ে কম। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আশংকা করা হচ্ছে যে, নতুন এই ভাইরাসটি ভাইরাল নিউমোনিয়াকে মহামারীর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ইতোমধ্যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ নেপাল, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর,জাপান, তাইওয়ান, হংকং, ফ্রান্স এবং ইউ এস এ তে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত করা হয়েছে।
চীনসহ এসকল দেশের বহু মানুষ বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করছেন। অন্যদিকে সেসব দেশেও অনেক বাংলাদেশী নাগরিকের বসবাস। এরা নিয়মিত বাংলাদেশে আসা যাওয়া করেন।
তাই সব মিলিয়ে বাংলাদেশও নভেল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ভাইরাসের সংক্রমণে ঝরে যেতে পারে ৬.৫ কোটি প্রাণ। যে কোন বয়সের মানুষই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। তবে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে এখনও পর্যন্ত কোনও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। প্রধানত: আগে থেকে অসুস্থ বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস মারাত্মক হতে পারে। তবে শহরাঞ্চলের দরিদ্র শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।
এছাড়া ভাইরাস নামক জীবাণুর বিরুদ্ধে কোন এন্টিবায়োটিক কাজ করে না বলে, এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে নিজেদের সচেতন হতে হবে। জানতে হবে এর বিস্তার, লক্ষণ এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে। সাধারণ সতর্কতা অবলম্বন করে আপনি এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারেন।
গঠন প্রকৃতিঃ
করোনাভাইরাস হলো নিদুভাইরাস শ্রেণীর করোনাভাইরদা পরিবারভুক্ত করোনাভাইরিনা উপগোত্রের একটি সংক্রমণ ভাইরাস প্রজাতি। এ ভাইরাসের জিনোম নিজস্ব আরএনএ দিয়ে গঠিত। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৬ থেকে ৩২ কিলো বেস পেয়ার (kilo base-pair) এর মধ্যে হয়ে থাকে যা এ ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ। করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ মুকুট। কারণ ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা মুকুটের মত। ভাইরাসের উপরিভাগে প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রামিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। সকল প্রজাতির করোনাভাইরাসে সাধারণত স্পাইক (এস), এনভেলপ (ই), মেমব্রেন (এম) এবং নিউক্লিওক্যাপসিড (এন) নামক চার ধরনের প্রেটিন দেখা যায়।
উৎপত্তির ইতিহাসঃ
করোনাভাইরাস ১৯৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দিকাশিতে আক্রন্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। এরপর থেকে বিভন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে ‘নোভেল করোনাভাইরাস’। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
লক্ষণ বা উপসর্গঃ
শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো নাক দিয়ে পানি পরা, গলা ব্যথা, কাশি এবং জ্বরসহ হালকা লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে এই ভাইরাস। কিছু মানুষের জন্য এই ভাইরাসের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। এর ফলে নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অর্গান বিপর্যয়ের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রেই এই রোগ মারাত্মক হয়। তবে, এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক ও আগে থেকে অসুস্থ ব্যক্তিদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যেভাবে ছড়ায়:
১। মূলত বাতাসে Air Droplet এর মাধ্যমে।
২। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি থেকে।
৩। আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ করলে।
৪। ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত কোন বস্তু স্পর্শ করলে।
৫। পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে।
প্রতিরোধ:
যেহেতু এখনো এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি তাই প্রতিরোধ ব্যবস্থাই পারে এর সংক্রমণ হতে আমাদের রক্ষা করতে।
১। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হওয়া।
২। ঘন ঘন সাবান এবং সেনিটাইজার ব্যবহার করে হাত,মুখমণ্ডল পরিষ্কার রাখা। যেমন-
- হাঁচি, কাশি দেয়ার পর।
- খাবার রান্না করা এবং খাওয়ার আগে।
- টয়লেট ব্যবহারের পর।
- পশু পাখি স্পর্শ করার পর।
- আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা করার পর।
- অন্য কোন কারনে হাত ময়লা হলে।
৩। হাত পরিষ্কার না করে নাক, মুখ, চোখ স্পর্শ না করা।
৪। হাঁচি,কাশি দেয়ার সময় মুখে রুমাল ব্যবহার করা।
৫। ঠান্ডা বা ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রাখা।চিকিৎসা সেবায় জড়িতদের প্রয়োজনে আলাদা মাস্ক, গ্লভস, এপ্রোন ব্যবহার করতে হবে।
৬। সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা রেখে সেবা দেয়া।
৭। অরক্ষিত বন্য জন্ত এবং গৃহপালিত প্রাণি থেকে সাবধান থাকার পাশাপাশি ডিম এবং মাংস খুব ভালোভাবে রান্না করতে হবে।
৮। কোন লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই নিকটস্থ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সবাই সচেতন হোন। সুস্থ থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
১। ইউনিসেফ.ওআরজি, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার
২। উইকিপিডিয়া/করোনাভাইরাস
৩। ডাঃ জান্নাতুন নাঈম, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হসপিটাল




