![]() |
| পশ্চিম আটলান্টিক অঞ্চলের ছবি, যেখানে দেখানো হয়েছে কথিত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অবস্থান |
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল যা শয়তানের ত্রিভূজ নামেও পরিচিত, আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল,
যেখান বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ায় কথা বলা হয়। অনেকে মনে করেন ঐ সকল অন্তর্ধানের কারণ নিছক দূর্ঘটনা, যার কারণ হতে পারে প্রাকৃতিক দূর্যোগ অথবা চালকের অসাবধানতা। আবার চলতি উপকথা অনুসারে এসবের পেছনে দায়ী হল কোন অতিপ্রকৃতিক কোন শক্তি বা ভিনগ্রহের কোন প্রাণীর উপস্থিতি। তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে যে ,
যেসব দূর্ঘটনার উপর ভিত্তি করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশ কিছু ভুল,
কিছু লেখক দ্বারা অতিরঞ্জিত হয়েছে এমনকি কিছু দূর্ঘটনার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের দূর্ঘটনার কোনই পার্থক্য নেই। তবুও কিছু মানুষ এসব রহস্য উদঘাটনে মরিয়া হয়ে ছুটেছে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। আর রহস্যপ্রিয় মানুষের এই দূর্বলতাকে পুঁজি করে পৃথিবীতে অনেক ধরনের বানিজ্য হয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল বা শয়তানের ত্রিভূজের রহস্য সেই রকম একটি ব্যবসা।
যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, বাহামা দ্বীপ এবং ক্যরিবীয়ান দ্বীপ এই তিনটি স্থানকে নিয়ে যে ত্রিভুজাকার এলাকা পাওয়া যায় সেটাই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্যময়তার জন্য সবার কাছেই কম বেশী পরিচিত।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিষয়ে বিভিন্ন লেখক লিখতে গিয়ে সর্বপ্রথম ক্রিস্টোফার কলম্বাসের কথা উল্লেখ করেছেন। কলম্বাস লিখেছিলেন যে তাঁর জাহাজের নবিকেরা এ অঞ্চলের দিগন্তে আলোর নাচানাচি, আকাশে ধোঁয়া দেখেছেন। এছাড়া তিনি এখানে কম্পাসের উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশনার কথাও বর্ণনা করেছেন।
১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর সর্বপ্রথম এ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে খবরের কাগজে লিখেন ই. ভি. ডব্লিউ. জোন্স( E.V.W.
Jones)। এর দুই বছর পরেই এই বিষয়ে ফেইট (Fate)ম্যাগাজিনে জর্জ এক্স. স্যান্ড( George
X. Sand) "Sea Mystery At Our Back Door" শিরোনামে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখেন। এ প্রবন্ধে তিনি ফ্লাইট নাইনটিন ( ইউ এস নেভী-র পাঁচটি ‘টি বি এম অ্যাভেন্জার’ বিমানের একটি দল,
যা প্রশিক্ষণ মিশনে গিয়ে নিখোঁজ হয়) এর নিরুদ্দেশের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং তিনিই প্রথম এই অপরিচিত ত্রিভূজাকার অঞ্চলের কথা সবার সামনে তুলে ধরেন।
ফ্লাইট নাইনটিনের দূর্ঘটনাকে আমেরিকান লিজান (American
Legion) ম্যগাজিনে
১৯৬২ সালে সর্বপ্রথম অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে দেখানো হয় (লেখক- Allen
W. Eckert (April 1962). "The Lost Patrol". American Legion.)। সেসময়ে
এই রহস্যময় ঘটনা নিয়ে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ১৯৬৪ সালে 'The
Deadly Bermuda Triangle' নামের আরেকটি কাহিনী ছাপিয়ে এই আলোড়নে আরো মশলা ঢালার কাজ করেন ভিনসেন্ট গডিস (Vincent
Gaddis) নামের
এক লেখক। এর উপরেই আরো রং চড়িয়ে 'Invisible
Horizons' নামের
বিখ্যাত বইটি লেখা হয় যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে আরো রহস্যাবৃত করে তোলে। বারমুডার বিষয়ে লেখালেখি পাঠক প্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসলে প্রকাশিত হয় আরো কিছু লেখকের বই। এর ভেতরে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে ওয়ালেস স্পেন্সারের "লিম্বো অফ দ্যা লস্ট" (Limbo
of the Lost, 1969, repr. 1973), রিচার্ড উইনারের "দ্যা ডেভিল'স ট্রায়াঙ্গেল" “শয়তানের ত্রিভূজ” (The Devil's Triangle, 1974) এবং চার্লস বার্লিটজ (Charles
Berlitz)-এর
সেই বিখ্যাত বই “দি বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল”(The Bermuda Triangle, 1974)। এদের
প্রায় সকলেই ঘুরেফিরে একার্ট (Eckert)
বর্ণিত অতিপ্রাকৃতিক ঘটানাই বিভিন্ন স্বাদে উপস্থাপন করেছেন।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিভিন্ন রহস্য বেশ কিছুটা সময় পর্যন্ত বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেলেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার ও আধুনিক স্যাটেলাইট ও নৌ যোগাযোগ পদ্ধতির কারণে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। এসময়টায় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে বেশ কিছু কৌতুহলী মানুষ ও প্রতিষ্ঠান গবেষণা শুরু করে। “অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি”-র রিসার্চ লাইব্রেরিয়ান লরেন্স ডেভিড কুসচ ১৯৭৫ সালে "দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল মিস্ট্রি: সলভড" নামে একটি বই বের করেন যেখানে তিনি চার্লস বার্লিটজ (Charles
Berlitz) এর
বর্ণনার সাথে প্রত্যক্ষ্যদর্শীদের বর্ণনার অসংগতিগুলো তুলে ধরতে সক্ষম হন। যেমন- যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমান থাকার পরেও বার্লিটজ (Charles
Berlitz) বিখ্যাত
ইয়টসম্যান ডোনাল্ড ক্রোহার্সট(Donald
Crowhurt) এর
অন্তর্ধানকে বর্ণনা করেছেন রহস্য হিসেবে। আরও একটি উদাহরণ হল- আটলান্টিকের এক বন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়ার তিন দিন পরে একটি আকরিকবাহী জাহাজের নিখোঁজ হবার কথা বার্লিটজ বর্ণনা করেছেন, আবার অন্য এক স্থানে একই জাহাজের কথা বর্ণনা করে বলেছেন সেটি নাকি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি বন্দর থেকে ছাড়ার পর নিখোঁজ হয়েছিল। এছাড়াও কুসচ(Kusche)
দেখান যে বর্ণিত দূর্ঘটনার একটি বড় অংশই ঘটেছে কথিত ত্রিভূজের সীমানার বাইরে। অথবা সবগুলো ঘটনাকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে আনতে গেলে ট্রায়াঙ্গলের আকৃতি আর ট্রায়াঙ্গলের মত থাকে না (উপরের ছবিটি দ্রষ্টব্য)। কুসচের গবেষনায় সহজ ভাবেই এসব লেখকের অসততা ফুটে ওঠে। তিনি লেখকদের বর্ণনায় বিভিন্ন দূর্ঘটনার তারিখ,
সময় ইত্যাদি অনুযায়ী সে সময়ের খবরের কাগজ থেকে আবহাওয়ার খবর আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংগ্রহ করেছেন যা গল্পে লেখকরা বলেননি। অথচ এসব আবহাওয়ার খবর আর সমসাময়িক ফ্যাক্টগুলোর কারণে অধিকাংশ দুর্ঘটনাই অতি-সাধারণ দুর্ঘটনায় পরিনত হয়। কুসচের গবেষনায় বেশ চমৎকার কিছু বিষয়ে বের হয়ে আসে যা নিয়ে এর আগে কেউ ভাবেনি। তার ভেতরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে-
1.
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে যে পরিমান জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ায় কথা বলা হয় তার পরিমান বিশ্বের অন্যান সমুদ্রের তুলনায় বেশি নয়।
2.
এ অঞ্চলে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড় (tropical
storms) নিয়মিত
আঘাত হানে, যা জাহাজ ও উড়োজাহাজ নিখোঁজ হওয়ার অন্যতম কারন। কিন্তু বার্লিটজ বা অন্য লেখকেরা এধরনের ঝড়ের কথা অনেকাংশেই এড়িয়ে গিয়েছেন।
3.
অনেক ঘটনার বর্ণনাতেই লেখকেরা কল্পনার রং চড়িয়েছেন। আবার কোন নৌকা নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে দেরিতে বন্দরে ভিড়লে তাকে নিখোঁজ বলে প্রচার করা হয়েছে।
4.
আবার কখনোই ঘটেনি এমন অনেক ঘটনার কথা লেখকেরা বলেছেন। যেমন- ১৯৩৭ সালে ফ্লোরিডার ডেটোনা সমুদ্রতীরে( Daytona
Beach) একটি
বিমান দূর্ঘটনার কথা বলা হয়,
কিন্তু সে সময়ের খবরের কাগজ থেকে এ বিষয়ে কোন তথ্যই পাওয়া যায়নি।
কুসচ –এর গবেষণার উপসংহারে বলা যায়- লেখকরা অজ্ঞতার কারনে অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বানোয়াট রহস্য তৈরি করেছেন।
বারমুডাকে রহস্যময় হিসেবে প্রচার করে বেড়ানো লেখকেরা কলম্বাসের রেফারেন্স দিলেও বিশেষজ্ঞরা কলম্বাসের প্রকৃত লগবুক পরীক্ষা করে পেলেন ভিন্ন চিত্র। এই লগ পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞরা যে মত দিয়েছেন তার সারমর্ম হল –
নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন তা হল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন,
আর কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। আকাশে অদ্ভুত রকমের আলোচ্ছটার আরো বহুরকম ব্যাখ্যা রয়েছে। অরোরা বোরিয়ালিস (aurora
borealis) তাদের
ভেতরে অন্যরকম.. (যদিও এটা মরু অঞ্চলে বেশী হয়)। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে নাবিকরা তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ ছিলো। আর তাদের ভেতরে কাজ করা নানারকম কুসংস্কারের। সাগরের ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরনের যে চিত্র দেখা যায় তেমন কিছু তৎকালীন নাবিকরা দেখে নানা রকম কাহিনী তৈরি করতো।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের বিষয়ে লিখিত বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের(USA)
কোস্ট গার্ড ব্যাপক অনুসন্ধানের পর অনুমোদন করেছে এই অঞ্চলে অস্বাভাবিক কিছু নেই।
বর্তমানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কথিত রহস্যজনক এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়তই কোনরকম বিপদ ও অস্বাভাবিকতা ছাড়াই হাজার হাজার জাহাজ ও বিমান চলাচল করছে। এসব জাহাজ আর বিমান যেসকল প্রতিষ্ঠানে বীমা করা হয় তেমন একটি মেরিন বীমা কোম্পানী “লয়েড'স অব লন্ডন”(Lloyd's
of London) অনুসন্ধান
করে নিশ্চিত হয়েছে যে ঐ এলাকায় এমন কোন অস্বাভাবিক কিছু নেই যার জন্য তারা ঐ অঞ্চল দিয়ে গমনকারী জাহাজের কাছ থেকে অতিরিক্ত মাশুল আদায় করতে পারে। উল্লেখ্য ঝুকিপূর্ন এলাকা দিয়ে চলাচলকারীদের কাছ থেকে বীমা কোম্পানী অতিরিক্ত মাশুল আদায় করে থাকে।
বারমুডাকে রহস্যাবৃত্ত করার কাজে নিয়োজিত অন্যতম লেখক John
Wallace Spencer (1969) তাঁর Limbo
Of The Lost বইয়ে
ভি.এ. ফগ (V.A.
Fogg) নামের
একটি ট্যাঙ্কারের বিধ্বস্ত হওয়ার কাহিনী উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,
"ঐ
ট্যাঙ্কারের সব আরোহী অদৃশ্য হয়ে গেছে,
শুধুমাত্র এর ক্যাপ্টেনকে তার কেবিনের টেবিলে হাতে কফির মগ ধরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।" অথচ কোস্ট গার্ডরা সে বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কারের ছবি তোলেন এবং বেশ কিছু মৃত দেহও উদ্ধার করেন
টিভি সিরিয়াল NOVA
/ Horizon এর
“ দ্যা কেস অব দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল (১৯৭৬-০৬-২৭)”
পর্বে বলা হয়েছিল ,
যে সব দূর্ঘটনার কথা বলা হয় সেগুলো ভিত্তিহীন।
১৯৪০ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া বেশ কিছু দূর্ঘটনার জন্য বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো গেলেও ১৯৯০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ১৯ বছরে তেমন কোন দোষ চাপানো যাচ্ছে না। তাহলে কি বারমুডার রহস্য হঠাৎ করে বাতাসে মিলিয়ে গেল?
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল খ্যাত অঞ্চলের কিছু অংশে স্থলভাগও রয়েছে। যেমন পোর্তো রিকো(Puerto
Rico), বাহামা
এমন কি বারমুডা নিজেই। এসব জায়গায় কোন রকম রহস্যের দেখা না পেয়েই মানুষজন নিশ্চিন্তেই বসবাস করে যাচ্ছে। এছাড়াও এই বারমুডার সীমানয় অবস্থিত ফ্রীপোর্ট শহরে বড়সড় জাহাজ কারখানা রয়েছে। সেখানে একটি একটি বিমান বন্দরও রয়েছে যারা কোনরকম গোলযোগ ছাড়াই বছরে ৫০,০০০ টি বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
একটা সময়ে পুরো দুনিয়া ও সাগর জুড়েই ঘটে যেত অনেক দুর্ঘটনা। এমনকি আজকের তথ্য-প্রযু্ক্তির যুগেও অনেক দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয় করা যায় না। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির "এয়ার ক্রাশ ইনভেস্টিগেশন" সিরিজটা যারা দেখেন তারা বিষয়টা জানেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মত আরো বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বাদ দিয়ে শুধু বারমুডাকেই কেন বিশেষ ভাবে হাইলাইট করা হলো?
সংশয়বাদী গবেষকগণ (আর্নেস্ট ট্যাভস ( Ernest
Taves)[২০]
এবং ব্যারি সিংগার( Barry
Singer) প্রমুখ)
এই বিষয়ে গবেষণা করে বলেছেন, "মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভজনক। কারন তখন ঐ মিথ্যে রহস্যের উপর ভিত্তি করে বই লিখে বা টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ কামানো যায়।"
উৎসঃ Wikipedia এবং ব্লগ থেকে সংগৃহীত।
